‘যথার্থ বাঙালি, যদি তুমি হও
ক্ষণিক দাঁড়িয়ে যাও, এই সমাধিস্থলে…’
এটি কবি সৈয়দ ফখরুদ্দিন মাহমুদের ৩৩ লাইনের কবিতা ‘একটি অমর সমাধি’র প্রথম দুই লাইন। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধ কমপ্লেক্সের এক নম্বর গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়বে পাথরে খোদাই করা ‘একটি অমর সমাধি’ কবিতাটি। প্রশস্ত পথের দুই পাশে রয়েছে ফুলের বাগান ও কৃত্রিম পাহাড়। এসবের মাঝেই পাঠাগার ও জাদুঘর। পথ ধরে আরও এগোলে বঙ্গবন্ধুর সমাধি।এ সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স গোপালগঞ্জ শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে টুঙ্গিপাড়ায়। জানা গেল, প্রতিদিনই দেশ-বিদেশি প্রায় চার হাজার দর্শনার্থী আসেন এখানে। জনশ্রুতি আছে, পারস্য থেকে কয়েকজন মুসলিম সাধক এই এলাকার প্লাবিত অংশে টং বেঁধে বসবাস করতে থাকেন। কালক্রমে ওই টং থেকেই এ এলাকার নামকরণ হয় টুঙ্গিপাড়া। এই টুঙ্গিপাড়াতেই ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটে শাহাদত বরণ করেন তিনি। পরের দিন টুঙ্গিপাড়ায় পারিবারিক কবরস্থানে মা ও বাবার পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
গণপূর্ত বিভাগের তত্ত্বাবধানে ৩৮.৩০ একর জমিতে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট বোর্ডের পরামর্শ মতো এই সমাধিসৌধের রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত করছে। টুঙ্গিপাড়ার বাইগার নদের পাড়ে বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক কবরস্থান ও এর আশপাশের এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে এ কমপ্লেক্স।
লাল সিরামিক ইট আর সাদা-কালো মার্বেল পাথর দিয়ে নির্মিত এ সৌধের কারুকাজে ফুটে উঠেছে বেদনার চিহ্ন। কমপ্লেক্সের সামনে, দুই পাশের উদ্যান পেরোনোর পরই বঙ্গবন্ধুর কবর। পাশে তাঁর বাবা ও মায়ের কবর। এই তিন কবর নিয়েই গড়ে উঠেছে গোলাকার গম্বুজবিশিষ্ট মূল সমাধিসৌধ। সমাধিসৌধের ওপরের দেয়ালে জাফরি কাটা। সব সময় আলোছায়ার মায়াবী খেলা সেখানে। ওপরে থাকা কারুকাজ করা কাচের ভেতর দিয়েও আলো ছড়িয়ে পড়ে সমাধিতে। চারদিকে কালো, মাঝখানে সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কবর বাঁধানো। ওপরের অংশ ফাঁকা।
এই কমপ্লেক্সে রয়েছে একটি পাঠাগার ও জাদুঘর। পাঠাগারে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা বইসহ প্রায় ছয় হাজার বই রয়েছে। রয়েছে গবেষণাকেন্দ্র, প্রদর্শনী কেন্দ্র, উন্মুক্ত মঞ্চ, পাবলিক প্লাজা, প্রশাসনিক ভবন, ক্যাফেটেরিয়া, বকুলতলা চত্বর ও স্যুভেনির কর্নার।
প্রদর্শনী কেন্দ্রে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের নানা পর্যায়ের আলোচিত্র ছাড়াও রয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন শিল্পীর আঁকা শিল্পকর্ম। এ ছাড়া মুক্তিসংগ্রামের নানা পর্যায়ের দেশ ও বিদেশ থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদপত্র। বঙ্গবন্ধুকে যে কফিনে করে ঢাকা থেকে সামরিক হেলিকপ্টারে করে নিয়ে আসা হয়েছিল, সেটিও সংরক্ষণ করা হয়েছে সযত্নে। দর্শনার্থীরা এখানে এসে আবেগে আপ্লুত হন। শ্রদ্ধা জানান বঙ্গবন্ধুকে।
প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সমাধিসৌধ খোলা থাকে। পাঠাগার খোলা থাকে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। বঙ্গবন্ধু সমাধিসৌধ কমপ্লেক্সের পাশেই টুঙ্গিপাড়া পৌরসভার উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছে ‘শেখ রাসেল শিশুপার্ক’। সেখানেও ঘুরে আসা যায়।
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিধন্য টুঙ্গিপাড়া
সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স শুধু নয়, এর আশপাশের এলাকায় আরও অনেক কিছুই দেখার রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আদি পৈতৃক বাড়ি, ছেলেবেলার খেলার মাঠ, বঙ্গবন্ধুর প্রিয় বালিশা আমগাছ, শেখ বাড়ি জামে মসজিদ (স্থাপিত হয়েছে ১৮৫৪ সালে) ইত্যাদি। আছে হিজলতলা ঘাট, যেখানে বঙ্গবন্ধু ছোটবেলায় গোসল করতেন। দেখা মিলবে শেখ পরিবারের ঐতিহ্যবাহী একটি বড় ও একটি ছোট আকারের পুকুরের।
টুঙ্গিপাড়ার গিমাডাঙ্গা গ্রামের ভ্যানচালক তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আমাদের এলাকা নিয়ে গর্ব করি। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আসেন এই সমাধিসৌধে। বঙ্গবন্ধুর জন্য আমাদের এ গৌরব।’
টুঙ্গিপাড়ার এই সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স ও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিধন্য নানা স্থাপনা ঘুরেফিরে আসার সময় কবিতার সেই পঙ্ক্তিগুলো মনে হয় বারবার।
যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।…
যাবেন যেভাবে
ঢাকা থেকে সারসরি বাসে টুঙ্গিপাড়া যাওয়া যায়। বাসের রয়েছে দুটি রুট। একটি গাবতলী থেকে পাটুরিয়া হয়ে, অপরটি গুলিস্তান থেকে মাওয়া ঘাট পাড় হয়ে। গাবতলী থেকে টুঙ্গিপাড়ার দূরত্ব ২৪০ কিলোমিটার। গোল্ডেন লাইন, সেবা গ্রিন লাইন, কমফোর্ট লাইন নামের বাসে টুঙ্গিপাড়া যেতে সময় লাগে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা। প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর বাস পাওয়া যায়। ভাড়া জনপ্রতি ৩৫০ টাকা।
গুলিস্তান থেকে টুঙ্গিপাড়ার দূরত্ব ১৬০ কিলোমিটার। এ পথে টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস, সেবা গ্রিস লাইন ও মধুমতী পরিবহনের বাসে চড়ে টুঙ্গিপাড়া যাওয়া যায়। প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর বাস পাওয়া যাবে। ভাড়া প্রতিজন ৩০০ টাকা।
আবাসন সুবিধা
‘মধুমতী’ নামে পর্যটনের একটি মোটেল আছে। এখানে থাকার ব্যবস্থা আছে। রুমের ভাড়া নন-এসি ৮০০ টাকা ও এসি ১৫০০ টাকা।
রাতযাপনের জন্য গোপালগঞ্জ শহরেও আছে বেশ কটি আবাসিক হোটেল। রুমের ভাড়া ৮০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে।
টুঙ্গিপাড়া উপজেলা (গোপালগঞ্জ জেলা) আয়তন: ১২৭.৮৭ বর্গ কিমি। অবস্থান: ২২°৫০´ থেকে ২৩°০১´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯°৪৮´ থেকে ৮৯°৫৭´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। সীমানা: উত্তরে গোপালগঞ্জ সদর ও কোটালিপাড়া উপজেলা, দক্ষিণে চিতলমারী ও নাজিরপুর উপজেলা, পূর্বে কোটালিপাড়া উপজেলা, পশ্চিমে মোল্লাহাট ও গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা।
জনসংখ্যা ৯৯৪৬২; পুরুষ ৫২০১৫, মহিলা ৪৭৪৪৭। মুসলিম ৬৭২৫০, হিন্দু ৩২১২৮, বৌদ্ধ ৭৪ এবং অন্যান্য ১০।
জলাশয় মধুমতি, সাইলদা, দরিয়ারগাঙ ও ঘাগর নদী এবং টুংরি খাল উল্লেখযোগ্য।
প্রশাসন টুঙ্গিপাড়া থানা গঠিত হয় ১৯৭৪ সালে এবং থানা উপজেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৯৫ সালে। টুঙ্গিপাড়া পৌরসভা গঠিত হয় ১৯৯৭ সালে।
মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি ১৯৭১ সালের ১৯ মে পাকবাহিনী টুঙ্গিপাড়া বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণ করে। ওই দিন তারা শেখ মিঠু, আরশাদ আলী, তোরাব আলী, ধলা মিয়া, সর্দার ও লিকুকে হত্যাসহ ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। ১১ জুলাই মুক্তিযোদ্ধারা (হেমায়েত বাহিনী) বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে অবস্থানরত রাজাকারদের ঘাটি আক্রমণ করে তাদের পরাজিত ও বিতাড়িত করে।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মসজিদ ১৩৬, মন্দির ২৪৩, গির্জা ৩, মাযার ১।
শিক্ষার হার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড় হার ৫২.২%; পুরুষ ৫৪.২%, মহিলা ৪৯.৯%। কলেজ ২, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১৮, প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬৫, কেজি স্কুল ৪, মাদ্রাসা ৫, মক্তব ১২৪। উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: শেখ মুজিবুর রহমান ডিগ্রি কলেজ (১৯৮৬), ড: ইমদাদুল হক মেমোরিয়াল কলেজ, নিলফা বয়রা উচ্চ বিদ্যালয় (১৯১৭), গিমাডাঙ্গা-টুংগিপাড়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় (১৯৪৬), গিমাডাঙ্গা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় (১৯৬৬), গোপালপুর পঞ্চপল্লী উচ্চ বিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, বাঁশবাড়িয়া ঝনঝনিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, গহরডাঙ্গা খাদেমুল ইসলাম মাদ্রাসা।
সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান লাইব্রেরি ৩, ক্লাব ২১, সিনেমা হল ১, সাংস্কৃতিক সংগঠন ২, ক্রীড়া সংগঠন ৫, মহিলা সমিতি ২৯।
গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বঙ্গবন্ধু স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্স।
জনগোষ্ঠীর আয়ের প্রধান উৎস কৃষি ৭০.০৮%, অকৃষি শ্রমিক ২.১৯%, ব্যবসা ১১.৩৬%, পরিবহণ ও যোগাযোগ ০.৯৯%, চাকরি ৮.৮২%, নির্মাণ ০.৫৮%, ধর্মীয় সেবা ০.৪১%, রেন্ট অ্যান্ড রেমিটেন্স ০.৩৫% এবং অন্যান্য ৫.২২%।
কৃষিভূমির মালিকানা ভূমিমালিক ৬৯.৯৯%, ভূমিহীন ৩০.০১। শহরে ৫৮.২৬% এবং গ্রামে ৭৬.৭৩% পরিবারের কৃষিজমি রয়েছে।
প্রধান কৃষি ফসল ধান, পাট, সরিষা, ডাল, মিষ্টি আলু, চীনাবাদাম, সূর্যমুখী, আখ, গম, পান, শাকসবজি।
বিলুপ্ত বা বিলুপ্তপ্রায় কৃষি ফসল তিল, তিসি।
প্রধান ফল-ফলাদি আম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, নারিকেল, তাল, পেয়ারা, লেবু, লিচু।
মৎস্য, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির খামার চিংড়ি ঘের ১৫৯৬, গবাদিপশু ১৭, হাঁস-মুরগি ৬৮, হ্যাচারি ২।
যোগাযোগ বিশেষত্ব পাকারাস্তা ৯৯ কিমি, আধা-পাকারাস্তা ১৬ কিমি, কাঁচারাস্তা ৯১ কিমি।
বিলুপ্ত বা বিলুপ্তপ্রায় সনাতন বাহন পাল্কি।
শিল্প ও কলকারখানা বেকারি, আইস ফ্যাক্টরি, ইটভাটা।
কুটিরশিল্প স্বর্ণশিল্প, লৌহশিল্প, মৃৎশিল্প, বুননশিল্প, বেতের কাজ, বাuঁশর কাজ, নকশি কাঁথা, নকশি পাখা, খেজুর পাতার পাটি, বিভিন্ন প্রকার জাল।
হাটবাজার ও মেলা পাটগাতী হাট, টুঙ্গিপাড়া হাট, নিলফা বাজার, বাঁশবাড়িয়া হাট, কুশলি হাট, তারাইল হাট, বাসুরিয়া হাট, গিমাডাঙ্গা হাট, সিংগীপাড়া হাট, ডুমুরিয়া হাট, লেবুতলা হাট, বর্ণীর হাট এবং গওহরডাঙ্গা মেলা, জোয়ারিয়া মেলা, ডুমুরিয়া মেলা ও গোপালপুর মেলা উল্লেখযোগ্য।
প্রধান রপ্তানিদ্রব্য পাট, তালের গুড়, গম, মিষ্টি আলু, শাকসবজি।
বিদ্যুৎ ব্যবহার এ উপজেলার সবকটি ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পল্লিবিদ্যুতায়ন কর্মসূচির আওতাধীন। তবে ২৯.২৯% পরিবারের বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।
প্রাকৃতিক সম্পদ এ উপজেলার বর্ণীর বাওড় এলাকায় পিট কয়লার সন্ধান পাওয়া গেছে।
পানীয়জলের উৎস নলকূপ ৮১.৩৯%, ট্যাপ ১.৫৫%, পুকুর ৮.৪৬% এবং অন্যান্য ৮.৬০%। এ উপজেলার ৮১% অগভীর নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
স্যানিটেশন ব্যবস্থা এ উপজেলার ৪৭.৯১% (গ্রামে ৪৫.৬৬% এবং শহরে ৫১.৮১%) পরিবার স্বাস্থ্যকর এবং ৪০.২৩% (গ্রামে ৪৩.০৩% এবং শহরে ৩৫.৩৪%) পরিবার অস্বাস্থ্যকর ল্যাট্রিন ব্যবহার করে। ১১.৮৬% পরিবারের কোনো ল্যাট্রিন সুবিধা নেই।
স্বাস্থ্যকেন্দ্র উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ১, পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র ৫, উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র ২, হাসপাতাল ১।
এনজিও ব্র্যাক, প্রশিকা, কারিতাস, আশা, ওয়ার্ল্ড ভিশন, সিসিডিবি। [পরিতোষ হালদার]
তথ্যসূত্র আদমশুমারি রিপোর্ট ২০০১, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো; টুঙ্গিপাড়া উপজেলা সাংস্কৃতিক সমীক্ষা প্রতিবেদন ২০০৭।
Design & Developed By: RTD IT ZONE
Leave a Reply