‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা/গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার/শেখ মুজিবুর রহমান।’
কবি অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতার এ পঙ্ক্তিমালা জানে না এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে এর বাস্তব প্রতিচ্ছবির দেখা মিলবে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় অবস্থিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে।
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে দর্শনার্থীরা যখন টুঙ্গিপাড়ায় প্রবেশ করে, তখনই চোখে পড়ে বঙ্গবন্ধু গেট। যার দুপাশে ভাস্কর মৃণাল হকের পরশে বঙ্গবন্ধুর রঙিন ছবি যেন হাসিমুখে বরণ করে নেয় যে কাউকে। মাইলখানেক পথ পেরুতেই দেখা মিলবে বঙ্গবন্ধু সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স।
প্রবেশদ্বারে স্বাগত জানাবে কবি সৈয়দ ফখরুদ্দিন মাহমুদের পাথরে খোদাই করা ‘একটি অমর সমাধি’ কবিতাটি। কয়েক কদম সামনে জাতির পিতার হাজারো স্মৃতিঘেরা স্থিরচিত্র সংবলিত জাদুঘর। যেখানে দেখা যাবে বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় শৈশব থেকে আমৃত্যু স্মৃতিবিজড়িত সব স্থিরচিত্র। চিত্রকর্মে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের নানা পর্যায়ের আলোকচিত্র ছাড়াও রয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন শিল্পীর আঁকা শিল্পকর্ম। এ ছাড়াও মুক্তিসংগ্রামের নানা পর্যায়ের দেশ ও বিদেশ থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদপত্র। বঙ্গবন্ধুকে যে কফিনে করে ঢাকা থেকে সামরিক হেলিকপ্টারে করে নিয়ে আসা হয়েছিল, সেটিও সংরক্ষণ করা হয়েছে সযত্নে। দর্শনার্থীরা এখানে এসে আবেগে আপ্লুত হন। জেনে নেয় তাদের জানা-অজানা বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে।
দুই তলা জাদুঘরের নিচতলায় রয়েছে পাঠাগার। পাঠাগারে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা বইসহ প্রায় ছয় হাজার বই রয়েছে। এর মধ্যে সাত ভাষায় অনূদিত বঙ্গবন্ধু স্বলিখিত অসমাপ্ত আত্মজীবনী সবচেয়ে আকর্ষণীয়। রয়েছে গবেষণাকেন্দ্র, প্রদর্শনী কেন্দ্র, উন্মুক্ত মঞ্চ, পাবলিক প্লাজা, প্রশাসনিক ভবন, ক্যাফেটেরিয়া, বকুলতলা চত্বর ও স্যুভেনির কর্নার।
জাদুঘর ভবনে সকাল থেকে সারা দিন লেগে থাকে দেশি-বিদেশি হাজারো মানুষের ঢল।
পাঠাগার হয়ে প্রশস্ত রাস্তার দুই পাশে রয়েছে ফুলের বাগান ও কৃত্রিম পাহাড়। দেশি-বিদেশি ফুলের অপরূপ সংমিশ্রণে যে কারো মনে সৌন্দর্যের পরশ বুলিয়ে দেয়। আর একটু এগোলেই চোখে পড়বে শেখ পরিবারের ঐতিহ্যবাহী বড় তালাব (পুকুর)। পুকুর পাড়জুড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষী আম-হিজলের বাগান। খানিক্ষণ হাঁটলেই বঙ্গবন্ধুর সমাধি।
বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স গোপালগঞ্জ শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে টুঙ্গিপাড়ায়। জানা গেল, প্রতিদিনই দেশ-বিদেশি প্রায় চার হাজার দর্শনার্থী আসেন এখানে। দর্শনার্থীদের জন্য কমপ্লেক্স খোলা থাকে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত।
এ টুঙ্গিপাড়াতেই ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটে শাহাদাতবরণ করেন তিনি। পরের দিন টুঙ্গিপাড়ায় পারিবারিক কবরস্থানে মা ও বাবার পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।
টুঙ্গিপাড়ার বাইগার নদীর পাড়ে বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক কবরস্থান ও এর আশপাশের এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে এ কমপ্লেক্স। ১৯৯৬ সালের তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। পরে ১৯৯৯ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ৭৯তম জন্মবার্ষিকীতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন এ সমাধির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। দীর্ঘ দুবছর কাজ শেষে ২০০১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এ সমাধি সৌধ কমপ্লেক্সের উদ্বোধন করেন। লাল সিরামিক ইট আর সাদা-কালো মার্বেল পাথর দিয়ে নির্মিত এ সৌধের কারুকাজে ফুটে উঠেছে বিষাদের চিহ্ন। কমপ্লেক্সের সামনে, দুই পাশের উদ্যান পেরোনোর পরই বঙ্গবন্ধুর কবর। পাশে তার বাবা ও মায়ের কবর। এই তিন কবর নিয়েই গড়ে উঠেছে গোলাকার গম্বুজবিশিষ্ট মূল সমাধিসৌধ। সমাধিসৌধের ওপরের দেওয়ালে জাফরি কাঁটা। সব সময় আলোছায়ার মায়াবী খেলা সেখানে। ওপরে থাকা কারুকাজ করা কাচের ভেতর দিয়েও আলো ছড়িয়ে পড়ে সমাধিতে। চারদিকে কালো, মাঝখানে সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কবর বাঁধানো। ওপরের অংশ ফাঁকা। গণপূর্ত বিভাগের তত্ত্বাবধানে ৩৮.৩০ একর জমিতে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট বোর্ডের পরামর্শ মতো এ সমাধিসৌধের রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে।
সমাধির একেবারেই সন্নিকটে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। স্মৃতিবিজড়িত এ বাড়ির কথা বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও বর্ণনা করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাড়িটি পাকিস্তানি হানাদারেরা পুড়িয়ে দেয়। যুদ্ধ পরবর্তীতে একই স্থানে সাদা রঙের বাড়িটি পুনর্নির্মিত হয়ে বঙ্গবন্ধু স্মৃতির শুভ্রতা ছড়াচ্ছে। এর একেবারেই গা ঘেঁষে রয়েছে শেখ পরিবারের পূর্বপুরুষদের বাড়ি। আদি বাড়ির চারপাশে এখনো বেশ কয়েক ঘরে বঙ্গবন্ধুর পরিজন বসবাস করছেন।
শুধু সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স নয়, এর আশপাশের এলাকায় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত অনেক কিছুই দেখার রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলার খেলার মাঠ, বঙ্গবন্ধুর প্রিয় বালিশা আমগাছ, শেখবাড়ি জামে মসজিদ (স্থাপিত ১৮৫৪ সাল) হিজলতলা ঘাট, রকেট স্টিমার ঘাট ও লঞ্চঘাট। মোটকথা টুঙ্গিপাড়ার বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত এসব স্থানে ভ্রমণ করে মুজিবপ্রেমীদের মনে জীবন্ত কিংবদন্তি বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি ধরা দেয়।
এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু সমাধিসৌধ কমপ্লেক্সের পাশেই টুঙ্গিপাড়া পৌরসভার উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছে ‘শেখ রাসেল শিশুপার্ক’। সেখানে বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের জন্য রাখা হয়েছে বিশ্রামাগার।
যাওয়ার উপায়
বাংলাদেশের যে কোনো জায়গা থেকেই গোপালগঞ্জের বাস ধরে টুঙ্গিপাড়া আসা যায়। এ ছাড়া ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে টুঙ্গিপাড়া যাওয়া যায়। তবে ঢাকা থেকে টুঙ্গিপাড়া যাওয়ার রুট দুটি। একটি গাবতলী থেকে পাটুরিয়া হয়ে, অপরটি গুলিস্তান থেকে মাওয়া ঘাট পার হয়ে। গাবতলী থেকে টুঙ্গিপাড়ার দূরত্ব ২৪২ কিলোমিটার। গোল্ডেন লাইন, সেবা গ্রিন লাইন, কমফোর্ট লাইন নামের বাসে টুঙ্গিপাড়া যেতে সময় লাগে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা। প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর বাস পাওয়া যায়। ভাড়া জনপ্রতি ৫৫০ টাকা।
গুলিস্তান থেকে টুঙ্গিপাড়ার দূরত্ব ১৬০ কিলোমিটার। এ পথে টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস, দোলা, পালকী ও ইমাদ পরিবহণের বাসে চড়ে টুঙ্গিপাড়া যাওয়া যায়। প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর যাবে। ভাড়া জনপ্রতি ৪৭০ টাকা করে। এসি গাড়িগুলোতে ভাড়া গুনতে হবে ৬০০ টাকা করে।
কোথায় থাকবেন
টুঙ্গিপাড়ায় বাগিয়া নদীর তীরবর্তী ‘মধুমতী’ নামে পর্যটনের একটি মোটেল আছে। গ্রামীণ প্রাকৃতিক পরিবেশের মাঝে এখানে থাকার সুব্যবস্থা রয়েছে। রুমের ভাড়া নন-এসি টুইন বেড ১,৩০০ টাকা ও এসি টুইন বেড ২,০০০ টাকা। এ ছাড়া ডরমিটরি বেডে ৪০০ টাকা করে থাকার সুযোগ রয়েছে। ডরমিটরির প্রতি রুমে চারজন করে থাকার সুযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া রাতযাপনের জন্য চাইলে গোপালগঞ্জ শহরেও থাকতে পারেন। এক্ষেত্রে হোটেল সোহাগ, রোহান, রাজ, জিমি, লুচি, শম্পা, শিমুলসহ বেশকটি হোটেল রয়েছে। রুমের ভাড়া গুনতে হবে ৬০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে।
Design & Developed By: RTD IT ZONE
Leave a Reply