দুই বছর ধরে কোভিড-১৯-এর ভয়াবহতায় গোটা বিশ্ব বিপর্যস্ত হয়েছে। ২০২০ সালে করোনার ভয়াবহতা শুরু হওয়ার পরে ২০২১ সালে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পৃথিবীব্যাপী তাণ্ডব চালিয়েছে। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অনেক মানুষ সুস্থ হয়েছেন, আবার সুস্থ হওয়ার পরেও অনেক মানুষ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন। আবার অনেকেই খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেছেন। বিজ্ঞানীদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় ২০২০ সালের শেষের দিকে করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হওয়ার পরে পৃথিবীব্যাপী জনগণের মধ্যে এক ধরনের আশা জেগেছিল এই মর্মে যে ভ্যাকসিন প্রদান করা হলে করোনার সংক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করা যাবে। বিভিন্ন কোম্পানি বিভিন্ন ধরনের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছে। বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যার একটি বড় অংশ ইতোমধ্যে ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছে।
ভ্যাকসিন প্রদান শুরু হলে কোভিড-১৯-এর ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পৃথিবীব্যাপী একটা ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। ২০২০ সালের চেয়ে ২০২১ সালে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণে মানুষের প্রাণহানি হয়েছে বেশি। এমনকি সংক্রমিত রোগের সংখ্যা বেশি ছিল। পরবর্তী সময়ে টিকা প্রদান এবং বিভিন্ন ধরনের প্রচেষ্টার ফলে গত বছরের শেষের দিকে ডেল্টার সংক্রমণ আস্তে আস্তে দুর্বল হতে থাকে। ২০২১ সালের আগস্ট মাসের পরে মধ্য ডিসেম্বর পর্যন্ত মোটামুটি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু ২০২১-এর নভেম্বর মাসে দক্ষিণ আফ্রিকায় চিহ্নিত করোনার ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপের বেশিরভাগ দেশসহ প্রায় সব দেশেই ডিসেম্বরের মধ্যে সংক্রমণ পরিস্থিতি ব্যাপক আকার ধারণ করে। যদিও প্রথমে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেছিলেন করোনার ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টার তুলনায় বেশি ভয়াবহ হবে। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের হার অনেক বেশি হলেও মৃত্যুঝুঁকি কম এবং হাসপাতালে ভর্তির হার কম। এই ধরনের গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হবার পরে পৃথিবীব্যাপী মানুষের মধ্যে এই ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে ভয় কমতে শুরু করে।
ফলে জনগণ করোনার সুরক্ষাবিধি মেনে চলার প্রতি অনীহা প্রদর্শন করা শুরু করে বিধায় সংক্রমণের হার খুব দ্রুততার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। স্পেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ করোনাকে প্যানডেমিক হিসেবে বিবেচনা না করে এন্ডেমিক হিসেবে বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এমনকি যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রীও এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ইঙ্গিত প্রদান করেছেন। তবে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও, ২০২২ সালের প্রথম দিক থেকে খুব দ্রুত পাল্টে যেতে শুরু করে। ভারতের অবস্থা গত দুই সপ্তাহের মধ্যে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গত ৪৮ ঘণ্টায় ভারতে ৫ লক্ষের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে। বাংলাদেশেও গত এক সপ্তাহে প্রতিদিন রোগী সংক্রমণের হার ২ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
তর্কের খাতিরে যদি আমরা ধরেও নিই যে ওমিক্রনে মৃত্যু ঝুঁকি অনেক কম, তবু আমাদের একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা যত বাড়বে, এর প্রভাব অন্যান্য সেক্টরে পড়তে শুরু করবে। আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে লক্ষ করি তাহলে দেখব যে যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক দিনে প্রায় ৫০ লক্ষ রোগী শনাক্ত হয়েছে। একদিনে ১১ লক্ষের বেশি রোগী শনাক্তের রেকর্ড হয়েছে সেখানে। যুক্তরাষ্ট্রে একদিনে ১ লক্ষ ২৫ হাজার রোগী হাসপাতালে ভর্তি হবার রেকর্ড হয়েছে। সেখানে মৃত্যুর হারও বেড়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যুক্তরাষ্ট্রে খাদ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে এক ধরনের নেতিবাচক অবস্থা তৈরি হয়েছে। কারণ, ২৫% ট্রাক ড্রাইভার ইতোমধ্যেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পণ্য পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত অনেক সংখ্যক ড্রাইভার করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ফলে খাদ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে এক ধরনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, যেটি আমাদের গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে একই অবস্থা। প্রতিদিন আড়াই লাখের ওপরে যদি রোগী শনাক্ত হয় এবং আক্রান্ত রোগীর ২ শতাংশের যদি হাসপাতালে ভর্তি হবার প্রয়োজন পড়ে তবে দশ দিনে রোগীর যে সংখ্যা হবে তাতে ভারতের হাসপাতালগুলোতে বিপর্যয় দেখা দেবে। এর সঙ্গে পরিবহনসহ অন্যান্য সেক্টরের কর্মচারী-কর্মকর্তারা যদি সংক্রমিত হয়, তাহলে দেশের সার্বিক বিপর্যয় অনিবার্য। বাংলাদেশে গত কয়েক দিনে রোগীর সংখ্যা বাড়লেও জনগণের মধ্যে করোনা সুরক্ষাবিধি মানার ক্ষেত্রে এক ধরনের অনীহা লক্ষ্য করা গেছে। গত সপ্তাহে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার ১১ দফা নির্দেশনা জারি করেছে, যা ১৩ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়েছে। এই ১১ দফা কার্যকর হলেও এর বাস্তবায়নের দিকে যদি আমরা লক্ষ করি তাহলে দেখবো যে প্রশাসনের তরফ থেকে এই ধারাগুলো বাস্তবায়নের তেমন কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
রাস্তাঘাটে জনগণ এখন পর্যন্ত মাস্ক পরছে না এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে রাস্তাঘাটে চলাচল করছে। সরকারের তরফ থেকে গণপরিবহনে ৫০ শতাংশ আসনে যাত্রী নিয়ে চলাচলের নির্দেশনা প্রদান করা হলেও বাস মালিকরা ঘোষণা দিয়েছেন শতভাগ যাত্রী নিয়ে বাস চালানোর। এমনকি গণপরিবহনে দুটি টিকা নেওয়ার সনদ দেখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানা গেছে যে এই নির্দেশনা বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হলেও সেগুলো মেনে চলা ও বাস্তবায়নের জন্য এখন পর্যন্ত পুরোপুরি ব্যবস্থা গ্রহণ হয়নি। এ ধরনের সিদ্ধান্ত কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা না গেলে খুব দ্রুতই করোনা পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। তখন পরিস্থিতি আবার গত বছরের মার্চ থেকে জুলাই মাসের মতো ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে সরকারে থেকে এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করা অনেক কঠিন। কারণ, সরকারকে একদিকে যেমন জনগণের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়টি বিবেচনা করতে হয়, ঠিক তেমনি সরকারকে অর্থনীতিকে সচল রাখার বিষয়টি ভাবতে হয়। আবার করোনা নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে সফল মাধ্যম- লকডাউন- বাস্তবায়ন করলে বিপুল সংখ্যক মানুষ-যারা দিন আনে দিন খায়- কষ্টের মধ্য দিয়ে দিনযাপন করে। তখন সার্বিকভাবে এর দায় সরকারের ওপরই বর্তায়। যদিও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য নেতৃত্বে গত দুই বছরে বাংলাদেশ খুব সফলভাবে করোনার প্রথম এবং দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা করেছে, তবে ওমিক্রন জনিত তৃতীয় ঢেউ মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে শুধু সরকারের তরফ থেকে নিয়ন্ত্রণমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেই হবে না, সেই নিয়ন্ত্রণমূলক নির্দেশনাগুলো যদি জনগণ মেনে না চলে তবে আমাদের জন্য ভয়াবহ দিন অপেক্ষা করছে।
এ কথা ঠিক যে বাংলাদেশ সরকার টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় খুব ভালো অবস্থানে রয়েছে। আমাদের দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ টিকার এক ডোজ গ্রহণ করেছে এবং ৫ কোটির ওপরে মানুষ দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণ করেছে। এমনকি ষাটোর্ধ্ব বয়সী মানুষ যারা টিকার দুই ডোজ গ্রহণ করেছে এবং সম্মুখ সারির যোদ্ধাদের টিকার বুস্টার ডোজ প্রদান করা শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিকা কার্যক্রম প্রায় শেষ হয়েছে। ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের টিকা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে এটা বলা যায় যে দেশে যেহেতু টিকা কার্যক্রম সঠিকভাবে চলছে, অতএব টিকা গ্রহণের পরে করোনা আক্রান্ত হয়ে মানুষের অবস্থা খুব খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে পাশাপাশি এটিও ঠিক, সরকারের আহ্বান সত্ত্বেও জনগণের একটি বড় অংশ এখন পর্যন্ত টিকা গ্রহণে অনীহা প্রদর্শন করেছে। এই গোষ্ঠী সংক্রমিত হলে তারা পরিবারসহ আশপাশের সবাইকে সংক্রমিত করবে।
পরিশেষে যে কথাটি বলতে চাই সেটি হচ্ছে, ওমিক্রন সম্পর্কে জনগণের মধ্যে ভয় কম থাকার কারণে পরিস্থিতি যেকোনও সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। ইতোমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে ওমিক্রনকে সাধারণ ভাইরাস হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। গত দুই বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে ওমিক্রনের বিরুদ্ধে জয়ী হবার জন্য আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিধি মেনে চলার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, করোনাকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। কারণ, এক বছরই করোনা শেষ হবে এ বিষয়ে কেউ বলতে পারবে না। অতএব, জীবন, অর্থনীতি ও জীবিকা একসঙ্গে চালিয়ে নিতে হলে করোনাকে সঙ্গে নিয়েই চলতে হবে। এই চলার পথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে করোনার সুরক্ষাবিধি মেনে চলা। মাস্ক পরা, ঘন ঘন হাত ধোয়া এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মাধ্যমে আমরা পারি করোনা তৃতীয় ঢেউয়ের আক্রমণ থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে।
ড. প্রণব কুমার পান্ডে
লেখক: অধ্যাপক, লোক-প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
Design & Developed By: RTD IT ZONE
Leave a Reply