বর্ণি বাওড়ের পটভূমি
টুঙ্গিপাড়া উপজেলার ঐতিহ্যবাহী প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর বৈচিত্রময় আমাদের বর্নি বাওড়। এটি গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া উপজেলার উত্তর-পশ্চিমে এবং গোপালগঞ্জ সদর থেকে দক্ষিন-পূর্বে প্রায় মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত বিশালাকার এক জলাভূমি ৷ যা সরাসরি মধুমতি নদীর সাথে সংযুক্ত ৷
পরিচিতি:-
নদী তার চলমান পথ হতে গতিপথ পরিবর্তন করে অন্য পথে প্রবাহিত হলে পূর্বের গতি পথের স্রোতধারা বন্ধ হয়ে যে বিশাল জলাভূমির সৃষ্টি হয় তাকে বাওড় বলে ৷ নদীর বাক থেকে বাওড় কথার সৃষ্টি হয়েছে ৷ বর্ণি বাওড় মধুমতি নদীর গতিপথ পরিবর্তনের প্রতিফলন ৷ নদী তার চলার বাক পরিবর্তন করে অপেক্ষাকৃত সরল পথে প্রবাহিত হলে পূর্বের অঞ্চলটি আকৃতিতে সাধারনত অশ্বক্ষুরাকৃতির হয়ে থাকে ৷ বর্ণি বাওড়ও ভৌগলিক আকৃতিতে তার ব্যাতিক্রম নয় ৷ বর্ণি বাওড় মূলত গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলায় এবং গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার আংশিক অঞ্চলে অবস্থিত ৷ এটি মূলত টুঙ্গিপাড়ার প্রধান দুটি ইউনিয়ন:- বর্ণি ইউনিয়ন ও কুশলি ইউনিয়নকে বিভক্ত করে এর মধ্য দিয়ে বাহিত হয়েছে ৷ বর্ণি বাওড় থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে একই থানাধিন(টুঙ্গিপাড়া) জম্নগ্রহন করেছিল বাঙ্গালি জাতির জনক ও সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ৷ তার সুযোগ্য কণ্যা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাড়িও এই একই এলাকায়৷
নামকরন ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:-
বর্ণি গ্রামটি পূর্বে মধুমতি বিধৌত এলাকা ছিল ৷ তখন এলাকাটির লোকজন জমিদারের ভূমি করের দায়ে খুবই অসস্তি বোধ করছিল ৷ এই সময়ে জমিদারের এক উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা আসেন ৷ তাদের অত্যাচারের কারনে ঐ কর্মকর্তাকে বরণ করে নিতে নারাজ থাকায় কর্মকর্তা জমিদারকে জানান যে, তাকে বরণ করা হয় নাই ৷ এই বরণ না করা কথা থেকে ঐ এলাকাটির নাম হয় বর্ণি (অনুমান ১৮৭০-১৯০০ সাল) ৷ অতপর উক্ত মধুমতি নদীর গতি হঠাৎ করে প্রায় ১৫০-২০০ বছর পূর্বে পরিবর্তন হয়ে বাওড়ের সৃষ্টি হওয়ায় বর্ণি গ্রামের নাম অনুসারে বিখ্যাত বাওড়ের নাম রাখা হয় বর্ণি বাওড়৷
প্রকৃতি:-
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও রুপ বৈচিত্রের দিক দিয়ে বর্ণি বাওড় সৃষ্টিকর্তার এক অপূর্ব দান ৷ বাওড়ের দু-তীরের সবুজ গ্রাম ও গাছগাছালি যে কোন ভ্রোমনার্থীকে আকৃষ্ট করবে ৷ এই জলাধারের সান্ত ও সচ্ছ পানির বিশাল অঞ্চল দেখতে অতি সুন্দর ৷ জোস্নারাতে তা যেন আরো ভিন্ন মাত্রা পায় ৷ বর্ষাকালে নদীতীরের জমিগুলো প্লাবিত হলে বাওড়ের সৌন্দর্য অন্যভাবে প্রস্ফুটিত হয় ৷ বাওড়ের কোথাও কোথাও সারি সারি কচুরিফুল ও কিছু সঙ্খক শাপলাফুল দেখতে অপরুপ লাগে ৷ বাওড় ও তীরের ক্ষেতগুলোতে পানিকৌড়ি,ডাহুক,হাসপাখি,বক সহ নানা প্রকার পাখির বিচরণ যা মানুষকে প্রাকৃতিক পরিবেশের এক অপার মনোরঞ্জোন দিয়ে থাকে ৷ বর্ণি বাওড়ের এই অপরুপ সৌন্দর্য এখানকার মানুষের জীবন ও মননেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে ৷
জীবন ও জীবিকা:-
বর্ণি বাওড় প্রাকৃতিক সাধু পানির মাছের অভয়াশ্রম ৷ পূর্বের ইতিহাস এখনও বলে বর্ণি বাওড়ের সুস্বাদু মাছের কথা ৷ বর্তমানে সেই দেশি মাছের পর্যাপ্ততা কিছুটা হ্রাস পেলেও বর্ণি বাওড় এখনও বিশাল এলাকার মাছের চাহিদার যোগান দিয়ে যাচ্ছে ৷ এ ছাড়া অত্র এলাকার আবাদি জমির পানির চাহিদার বড় অংশ পুরন করে থাকে এ বাওড় ৷ মাছ সংগ্রহকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল নদীতীরবর্তি জেলে সম্প্রদায় ৷ যাদের জীবন ও জীবিকা এখনও এ বাওড়কে কেন্দ্র করে ৷ এ সকল জেলে সম্প্রদায়,মৎস ব্যাবসায়ি,নৌকা চালক ছাড়াও নানা পেশার মানুষ বর্ণি বাওড়ের দানের উপর তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে৷
যোগাযোগ:-
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, আশি বা নব্বই দশকের সময় পর্যন্ত টুঙ্গিপাড়া তথা বর্ণি বাওড়ের তীরবর্তি জনজীবনের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল বিখ্যাত এই বর্ণি বাওড় ৷ ছোট টাবুরিয়া নৌকা ও ডিজেল ইঞ্জিন চালিত ট্রলার নৌকা দ্বারা এলাকার মানুষ শহরের সাথে যোগাযোগ ও সংযোগ স্থাপন করতো ৷ বর্ণি বাওড়ই ছিল এখানকার লোকের একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা ৷ নদী পারাপারের জন্য খেয়া নৌকা ও ফসল ঘরে তোলার জন্য নৌকার ব্যবহার বর্ণি বাওড়ে এখনও বিদ্বমান ৷ স্থল পথে যোগাযোগ ব্যাবস্থা উন্নত হওয়ার দরুন বর্ণি বাওড়ে এখন সেই টাবুরিয়া নৌকা কালে-ভদ্রে দেখাও বিরল ৷ তবে এখনও খেয়া পারাপার ও স্থানীয় হাট-বাজারে যাতায়াতের জন্য এ বাওড়ের ব্যবহার অপরিহার্য৷
সংস্কৃতি:-
বর্ণি বাওড়ের সাথে এলাকার মানুষের সংস্কৃতির নিবিড় সম্পর্ক লক্ষ করা যায় ৷ বর্ষার জলপূর্ণ মৌসুমে বর্ণি বাওড়ে প্রায় প্রতিবছরই আয়োজিত হয়ে থাকে এখানকার ঐতিয্যবাহি নৌকা বাইচ ৷ যাকে স্থানীয় লোকজন বাচারি(নৌকা বাইচে ব্যবহৃত লম্বা বিশেষ নৌকা) বাইচ বলে থাকে ৷ দুর-দিগন্ত থেকে আগত হাজার হাজার মানুষ বাওড়ের দু-তীরে ভিড় করে উক্ত নৌকা বাইচ দেখার জন্য ৷ এ বাইচকে কেন্দ্র করে হয় নাচ,গান,মেলা ও ভোজন উৎসব ৷ পার্শবর্তি এলাকা ছাড়াও দুর-দুরান্ত থেকে নৌকা আসে বাইচে অংশ নিতে ৷ এ ছাড়াও পরন্ত বিকেলে বা জোস্নারাতে বাওড়ে ভ্রমনও জনজীবনে সংস্কৃতির ধারা বহন করে ৷ গড়ে ওঠা নদীতীরবর্তি হাট-বাজার ও স্থাপনাগুলো এলাকার মানুষের জীবন ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে৷
ভ্রমন:-
বর্ণি বাওড়ের সৌন্দর্য নিজ চোঁখে উপভোগ করতে চাইলে অথবা অবসরে নৌকা ভ্রমন বা বর্শি দিয়ে মাছ ধরার সখ থাকলে নির্দ্বিধায় চলে আসতে পারেন বর্ণি বাওড়ে ৷ এটি গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া উপজেলায় অবস্থিত ৷ স্থল পথে গোপালগঞ্জ সদরের মান্দারতলা নামক স্থানে নেমে ইজি বাইক/রিক্সাযোগে অল্প সময়ে সরাসরি চলে আসতে পারেন বর্ণি বাওড়ে ৷ অথবা গোপালগঞ্জ-টুঙ্গিপাড়া সড়কের শিঙ্গিপাড়া বাজার(বর্ণি) বা মালেকের হাট(কুশলি) দিয়েও আসা যায় ৷ এ ছাড়া নৌ পথে মধুমতি নদী দিয়েও চলে আসতে পারেন অপূর্ব সুন্দর এই জলাভূমি বর্ণি বাওড়ে৷ সবাইকে আনন্দ ভ্রমনের জন্য সাদর আমন্ত্রন৷
(ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত তথ্য)
Design & Developed By: RTD IT ZONE
Leave a Reply